গুগল আর্থ দেখেই ইচ্ছেটার জন্ম হয়। এরপর সেখান থেকে জেকে বসে চাকরির বাসনা। কিন্তু বিধি বাম, গুগল তখন লোক নিচ্ছে না। সাফ জানিয়ে দিলেন, বাংলাদেশে আসা এক গুগল কর্মকর্তা। বিকল্প পথও বাতলে দিলেন তিনি। প্রথমেই যোগ দিতে হবে গুগলের কমিউনিটিতে।
কিন্তু হায়, এখানেও আছে নানা বাধা, যা হুট করেই পার করা সম্ভব না। কিন্তু নিজের অদম্য ইচ্ছাকে শক্তিতে রুপান্তর করে হুবুহু গুগলের মতোই একটি কমিউনিটি তৈরি করে ফেললেন। আনঅফিসিয়ালি শুরু করলেন কমিউনিটির কাজকর্ম। উদ্যমী তরুণ মাহাবুব হাসানের হাত ধরে এভাবেই শুরু হয় ‘বাংলাদেশ লোকাল গাইড’ এর পথচলা।
বাংলাদেশ লোকাল গাইডের মডারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মাহাবুব। এছাড়াও প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বাম্বল বি’ নামের নিজের একটি সফট্ওয়্যার ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট টিম। সম্প্রতি নিজেদের বানানো অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে ব্র্যাক আয়োজিত সামাজিক সমস্যা সমাধান ও উন্নয়নের লক্ষ্যে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরির প্রতিযোগিতা ‘ব্র্যাকাথন’ এ আটটি বিভাগে ১১টি বিজয়ী দলের মধ্যে ছিল তার দলও।
মঙ্গলবার আইসিটি সংবাদের এক আলাপচারিতায় উঠে আসে লোকাল গাইডের শুরু থেকে এই পর্যন্ত আসা এবং মাহাবুবের ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা।
আইসিটি সংবাদ: ব্র্যাকাথনে জয়ের গল্পটা জানতে চাই…
মাহাবুব: এবারের ব্র্যাকাথনে আমরা স্কুল মনিটরিং টুল বিভাগে বিজয়ী হই। এখানে আমরা মূলত ব্র্যাকের জন্য ‘ব্র্যাক ই-স্কুল’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করেছিলাম। যেখানে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে ব্র্যাকের স্কুলগুলোকে অফলাইনেও পরিচালনা করতে পারবে। এজন্য ব্র্যাকের মাঠকর্মীদের একটি স্মার্ট ডিভাইস দিতে হবে এবং সে স্কুলগুলোতে গিয়ে সেখানকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে সাথে সাথে অ্যাপটিতে সংরক্ষণ করতে পারবে। পরে ইন্টারনেটের আওতায় এসে তা সে সেন্ট্রাল সার্ভারের সাথে কানেক্ট করতে পারবে। এতে করে আগে যেই স্কুল সম্পর্কিত নানা তথ্য ও কাগজপত্র আসতে দুই থেকে তিনদিন সময় লাগতো, এই অ্যাপ ব্যবহারের ফলে তা আর লাগবে না। একইসাথে এই অ্যাপ দিয়েই শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করা যাবে এবং সেই রিপোর্টও এখানে সংরক্ষণ করা যাবে।
আইসিটি সংবাদ: ‘বাম্বল বি’ নিয়ে আর কী করছেন?
মাহাবুব: ‘বাম্বল বি’ নিয়ে এর আগেও সরকারি একটা ইভেন্টে সিকিউরিটি চেকিং সিস্টেম বিষয়ে কাজ করেছিলাম। এছাড়াও এখান থেকে ওয়েব ডেভেলপমেন্ট নিয়েও করছি। ইতিমধ্যেই একটি গার্মেন্টস ও একটি মোবাইল কোম্পানির জন্য গুগল স্ট্রিট ভিউ এর মতো করে ‘বিজনেস ভিউ’ তৈরি করেছি।
আইসিটি সংবাদ: গুগলের সাথে পথচলা কী করে?
মাহাবুব: গুগলের সাথে পরিচয় একটু অন্যভাবে। ক্লাস সেভেনে পড়া অবস্থাতেই আমার ইন্টারনেটের প্রতি আগ্রহ অনেক বেড়ে যায়। নিয়মিত সাইবার ক্যাফেতে যাতায়াত করতাম, ইন্টারনেট ঘাঁটার জন্য। তখন গুগল আর্থ দেখে, মনে প্রাণে খুব ইচ্ছে জাগে আমিও এভাবে যদি ম্যাপিং করতে পারতাম। এভাবেই খোঁজ নিতে নিতে ২০১১ সালে যোগ দিলাম গুগলের ম্যাপিং কমিউনিটিতে। এরপর সে বছরের শেষের দিকেই যোগ দিলাম গুগল ডেভেলপার গ্রুপ (জিডিজি) ঢাকাতে। ওখান থেকেই আমার মূলত গুগলের সাথে কাজ করা শুরু হয়।
আইসিটি সংবাদ: এরপর লোকাল গাইডে এলেন কী করে?
মাহাবুব: ‘জিডিজি ঢাকা’র সাথে কাজ করতে করতে ২০১৪ সালে আমি গুগল ট্রান্সলেট প্রোগ্রামের একটি প্রজেক্টে বাংলাদেশ থেকে কাজ করার সুযোগ পাই। তখন গুগল থেকে কয়েকজন কর্মকর্তা এসেছিলেন। তাদের মধ্যেই একজন ছিলেন ক্যাথি সেন্ডারস। তাকে জানাই, গুগলে চাকরি করার আগ্রহের কথা। তখন সেটা সম্ভব না জানিয়ে সে বললো, ‘তুমি লোকাল হিসেবে শুরু করতে পারো।’ কিন্তু তখন বিদেশের ২৩টি কমিউনিটির আর কেউ লোকাল গাইডে কাজ করতে পারতো না। তাই আমাকেও অনেক বেগ পোহাতে হয়েছে। আর গুগল লোকাল গাইড তখনও বাংলাদেশ চিনে না, তাই তারা আমাকে সদস্য হিসেবে এপ্রুভ করেনি। তখন আমি নিজের উদ্যোগেই বিশ্ববিদ্যালয়য়ের কিছু ছোটভাইকে নিয়ে শুরু করলাম রিভিউ লেখা। এরপর ২০১৪ সালের ৭ মার্চ শুরু হয় বিশ্বের প্রথম আন-অফিসিয়াল গুগল কমিউনিটি বাংলাদেশ লোকাল গাইড। সেখান থেকেই কাজ করতে করতে আমি এই কমিউনিটির মডারেটর হলাম। এরপর ধীরে ধীরে দেশের বাইরেও অন্য কয়েকটা দেশের বন্ধুদেরকে তাদের দেশে লোকাল গাইড কমিউনিটি খুলতে সাহায্য করলাম।
আইসিটি সংবাদ: আমাদের দেশে লোকাল গাইডের সংখ্যা কেমন?
মাহাবুব: আমাদের দেশে যদিও আমরাই প্রথম এবং সবচেয়ে বড় লোকাল গাইড কমিউনিটি, এরপরও আমাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় চার হাজার। কিন্তু এখনও বাংলাদেশে মোট ৭টা লোকাল গাইড কমিউনিটি আছে। যেখানে সর্বমোট সদস্য সংখ্যা হবে প্রায় ছয় হাজার।
আইসিটি সংবাদ: লোকাল গাইডদের কাজটা কী?
মাহাবুব: লোকাল গাইডদের কাজ হচ্ছে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নিজের আশেপাশের পরিচিত সকল স্থান, যেমন- স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মন্দির, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, দর্শনীয় স্থানসহ বিভিন্ন স্থাপনার ভাল মন্দ দিকগুলো গুগল ম্যাপে রেটিং এবং রিভিউ দ্বারা তুলে ধরা। ধরুন, কোনো খাবারের মান খারাপ বা নকল কিছু ধরিয়ে দিতে পারেন। অথবা কোথাও বিশেষ কিছু পাওয়া যায় উল্লেখ করে সকলকে জানিয়ে দিতে পারেন। লোকেশনের ছবি যোগ করে আরও সহজ করে তুলতে পারেন। এতে করে ঐ এলাকায় বা স্থানে আগত দর্শনার্থী বা ক্রেতাগণের একইসাথে সময়, অর্থ এবং শ্রম বাঁচবে। ধরুন, আপনি কক্সবাজার যাবেন, কোথায় থাকবেন, হোটেল ভাড়া কেমন, আপনার বাজেট এর সাথে মিলবে কিনা, তা জানতে হলে কক্সবাজার গিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে তারপর আপনাকে হোটেল খুঁজতে হবে। অনেকেই আবার অনেক সময় দালালের খপ্পরে পড়েও প্রতারিত হন। কিন্তু আপনি যদি ম্যাপে হোটেলগুলোর মান, ভাড়া, হোটেলের ভেতরের পরিবেশের ছবি দেখে নিতে পারেন তাহলে এটি নিশ্চিত হয়ে যেতে পারেন। আরও সহজভাবে বলতে গেলে, লোকাল গাইডের মাধ্যমে প্রতিটি বিষয়বস্তুর ভাল-মন্দ দিক তুলে ধরা যাবে, অনেক ছোট ছোট পণ্য ও সেবার মান তুলে ধরা যায়।
আইসিটি সংবাদ: কেউ লোকাল গাইডে যোগ দিতে চাইলে কীভাবে শুরু করবে?
মাহাবুব: যেকোনো জিমেইল ব্যবহারকারী গুগল লোকাল গাইডে যোগ দিতে পারবেন। এজন্য তাকে প্রথমে এই লিঙ্কে প্রবেশ করতে হবে। এখানে ‘জয়েন নাও’ বাটনে ক্লিক করে ব্যবহারকারীর জিমেইল দিয়ে লগইন করে, তার বিভাগ আর নাম দিয়ে দুটি বাটন ক্লিক করতে হবে। এভাবেই প্রোফাইল তৈরি করে ইউজার রিভিউ করতে পারবেন। রিভিউ দুইভাবে করা যায়। অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসের গুগল ম্যাপ অ্যাপ দিয়ে অথবা maps.google.com থেকে লোকেশন সার্চ করে। আপনি যে লোকেশন রিভিউ করতে চান তা খুঁজে বের করুন, রাইট- এ রিভিউতে ক্লিক করে আপনি আপনার রিভিউ রেটিং দিতে পারেন। ২০-৬০ শব্দের মাঝে আপনার রিভিউ তুলে ধরুন এমনভাবে যেন একজন পড়ে ওই স্থানের পুরো ব্যাপারটি বুঝতে পারে। যেমন ধরুন; ইহা একটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। এখানে উচ্চ মাধ্যমিক শাখাও আছে। বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায়িক শাখাও রয়েছে। তবে অন্য কোনো জায়গা থেকে কপি পেস্ট করে বা অন্য কারও রিভিউ কপি করলে তা স্প্যাম রিভিউয়ার হিসেবে ধরা হয়।
আইসিটি সংবাদ: ‘লোকাল গাইড’ গুগল থেকে কী কী সুবিধা পায়?
মাহাবুব: সেভাবে বলতে গেলে লোকাল গাইড হয়ে গুগল থেকে তেমন কোনো সুবিধা পাওয়া যায় না। তবে তারা এই রিভিউর বিনিময়ে কিছু পয়েন্ট পেয়ে থাকে গুগল থেকে। একটি টেক্সট রিভিউ বা ফটো রিভিউ অথবা প্লেস অ্যাড করার জন্য এক পয়েন্ট দেয় গুগল। এই পয়েন্টের ওপর ভিত্তি করে কয়েকটা লেভেল হয়। সেখানে কিছু গিফট থাকে। যেমন কেউ যদি ২০০ পয়েন্ট করে, তাহলে সে লেভেল ফোরে পৌঁছে যাবে এবং ১০০ জিবি গুগল ড্রাইভ স্টোরেজ স্পেস ফ্রি পাবে। যদিও এই মাসের ১৭ তারিখ থেকে গুগল এটা বন্ধ করে দিয়েছে। হয়তো নতুন কোনো সার্ভিস দিবে সেই উদ্দেশ্যেই। আর লেভেল ফাইভে যেতে লাগবে ৫০০ পয়েন্ট। এই লেভেলে গিয়ে একজন ব্যবহারকারী কমিউনিটি মডারেটর হওয়ার যোগ্যতা পায়। এছাড়াও গুগল কমিউনিটি মডারেটরদের নিয়ে একটি বাৎসরিক মিটআপের আয়োজন করে। সেখানে যাওয়ার সক্ষমতা অর্জন হয় লেভেল ফাইভে পৌঁছালেই। একইসাথে যারা ভালো করে গুগল তাদের কিছু ফিজিক্যাল গিফটও পাঠায়।
আইসিটি সংবাদ: আপনি এখন পর্যন্ত গুগল থেকে কি কি গিফট পেয়েছেন?
মাহাবুব: আমি এখন পর্যন্ত গুগল থেকে একটি স্মার্টফোন পেয়েছি, নেক্সাস ৯ ট্যাব পেয়েছি। এক টেরাবাইট ড্রাইভ স্পেস পেয়েছি। এছাড়াও মাঝে মাঝে নানা ধরনের ছোট ছোট গিফট গুগল পাঠায়।
আইসিটি সংবাদ: গুগল লোকাল গাইড নিয়ে বাংলাদেশে আপনারা এখন পর্যন্ত কী করেছেন?
মাহাবুব: বাংলাদেশ লোকাল গাইড কমিউনিটির পক্ষ থেকে আমরা এখন পর্যন্ত পাঁচটা বিভাগের বিভিন্ন জেলা শহরসহ প্রায় ৬০টিরও বেশি মিট-আপ সম্পন্ন করেছি। এর মধ্যে আমাদের ৫০-তম মিটআপ লোকাল গাইডের অফিসিয়াল জি প্লাস ও ফেসবুক পেইজ থেকে শেয়ার দেওয়া হয়েছে। এসব মিটআপের মধ্যে আমরা হেলথ ক্যাম্প, ব্লাড গ্রুপিং, পরিচ্ছন্নতা অভিযান, ম্যাপ এপিআই বা কাস্টর ম্যাপিং নিয়ে সেমিনার, ফটোওয়াকসহ নানা ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। এছাড়াও আগামীকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে ৮ সদস্য নিয়ে ভারতে অনুষ্ঠিতব্য সাউথ এশিয়ান মিটআপে যাচ্ছি। এই মিটআপের আয়োজকও আমরা বাংলাদেশ। এখানে শ্রীলংকা, নেপাল ও ভারতের লোকাল গাইড কমিউনিটি মডারেটররা থাকবেন।
আইসিটি সংবাদ: আপনি তো গুগলে চাকরি করতে চেয়েছেন, কিন্তু হয়নি। সেটা নিয়ে আপনার কোনো ক্ষোভ কাজ করে না?
মাহাবুব: নাহ। আমার কোনো ক্ষোভ কাজ করে না। চাকরি হয়নি তাতে কী হয়েছে? আমি তো এখন গুগলের সাথেই কাজ করছি। সেচ্ছাসেবক হয়েই জিডিজি ঢাকার কমিউনিটি ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। গুগল ম্যাপস এর রিজিওনাল লিড হিসেবেও আছি। এছাড়াও বাণিজ্যিক উদ্দ্যেশ্যে গুগল বিজনেস ভিউ এর লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা শুরু করছি। তো সবকিছুই বলা চলে গুগলের সাথেই। আর আমার ইচ্ছেটা প্রযুক্তির সাথে পথচলার উদ্দেশ্যে ছিল, তা তো এখনও হচ্ছে। তাই এখন আর কোনো ক্ষোভ নেই বললেই চলে। কারণ এখন আমার কাজের মাধ্যমে আমি বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান ছাড়াও আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে সারা বিশ্ববাসীকে জানাতে পারছি।
আইসিটি সংবাদ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মাহাবুব: আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা হচ্ছে একটা আইটিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান করতে চাই। যেখান থেকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম ছাড়াও সামাজিক উন্নয়নে কিছু কাজ করতে পারি। দেশকে এগিয়ে নিতে অবদান রাখতে চাই। শিক্ষাখাতে কিছু কাজ করতে চাই। শিক্ষার্থীদেরকে দিয়েই টিউটোরিয়ালগুলো তৈরি করাতে চাই। এছাড়াও সাধারণ সমস্যাগুলোর সমাধানমূলক কিছু কর্মকান্ড করতে চাই। এখন সেগুলো নিয়েই ভাবছি। সামর্থ্যের মধ্যে চলে আসলেই কাজ শুরু করে দিব।
from ICT Shongbad http://ift.tt/2ncnfKh
Comments
Post a Comment